"চোখের নেয়ামত: নজরের হেফাজতে আল্লাহর আদেশ ও উপলব্ধি"




যোহরের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলাম। দুপুরের এই তপ্ত রোদে রাস্তায় তেমন মানুষ ছিলোনা, বলা চলে পুরো ফাঁকাই ছিলো।


হঠাৎ, মাথায় উদ্ভট এক চিন্তা এলো। “আচ্ছা দেখিতো, চোখ বন্ধ করে আমি কতদূর হাঁটতে পারি!” 


চোখ দু'টো বন্ধ করলাম, এক পা দু পা করে ধীরগতিতে এগোতে লাগলাম। যে রাস্তা দিয়ে আমি বাড়ি ফিরছিলাম, রোজ-ই এ রাস্তায় আমার যাতায়াত হয়। বলা যেতে পারে, এ রাস্তার নাড়ি নক্ষত্র আমার খুব ভালো করেই চেনা। কিন্তু কৃত্তিম অন্ধত্বের ফলে আমার কাছে এ চেনা রাস্তাও যেনো অচেনা হয়ে উঠলো। মনে হচ্ছিল যেন কোনো অচেনা পথ পাড়ি দিচ্ছি আমি। 


“এমন নিকষকালো পথের সাথে কি কোনদিন আমার পরিচয় হয়েছিল? এ পথে কি কোনদিন যাতায়াত করেছিলাম আমি?” 


—“না, এ পথ তো আমার পরিচিত নয়! এপথে তো আমি আগে কোনদিন হাঁটিনি!”


চারদিক অন্ধকার, এই বুঝি পড়ে যাচ্ছি কোন অতল গহ্বরে, মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে যাচ্ছি কোন ঘুটঘুটে অন্ধকার পথে! এই বুঝি কিছু একটার সাথে ধাক্কা খাচ্ছি। 

সে এক করুণ অবস্থা! হঠাৎ লোকজনের গলার স্বর অনুভব করলাম। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে ফেললাম। যদি তারা আবার আমায় পাগল বা অন্ধ ভাবে! 


বেশিক্ষণ না, এই কৃত্রিম অন্ধত্বের অস্তিত্ব ছিল কেবল দশ থেকে পনেরো  সেকেন্ডে। এ কয়েক সেকেন্ডেই আমি উপলব্ধি করতে পারি 'আমার এ দুচোখের গুরুত্ব'। এ দু’চোখ আল্লাহতায়ালার কত বড় নিয়ামত। সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী! এবার আপনার পালা। নিরবে, একাকী বসে চোখ দুটো বন্ধ করুন। যার চোখ নেই কিংবা যে ব্যক্তি অন্ধ তার ব্যাপারে একটু ভাবুন তো! সে কি এ সুন্দর পৃথিবীর কোনো দৃশ্য দেখতে পারছে? সে কি দেখতে পারছে এই সবুজ-শ্যামল বাংলা? সে কি দেখতে পারছে সুউচ্চ পর্বত, বহমান নদী নালা, বিস্তৃত নীল আকাশ? তার মস্তিষ্কে কি আঁকা  আছে কোনো ধুধু মরুভূমি,দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র,  সাদা বরফের ঢাকা হিমালয়ের সতেজ চিত্র? 


–না, সে দেখেনি এ পৃথিবীর সৌন্দর্য, দেখেনি সুউচ্চ পাহাড়, দেখেনি কলকল শব্দ করতে থাকা বহমান নদী, গর্জন করতে থাকা বিশাল সমুদ্র। তার কি ইচ্ছা যাগে না, এ পৃথিবীর সৌন্দর্য একটি বারের জন্য দেখবার? যাগে, যাগে, অবশ্যই যাগে। কিন্তু কি আর করার,  তার মালিক যে তাকে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। আর মালিকের সিদ্ধান্তেই তো কল্যাণ নিহিত রয়েছে।  তিনি প্রত্যেক ঘটনাই সংঘটিত করেন সেই ঘটনায় অন্তর্নিহিত কল্যাণসহ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন— 


  • “.....এমন তো হতে পারে, যা কিছু তোমরা পছন্দ করো না তার মধ্যেই আল্লাহ তা'আলা তোমাদের জন্য অদুরন্ত কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।”  [সুরা আন-নিসা, আয়াত:১৯] 


সে তো প্রকৃত অর্থেই অন্ধ, দৃষ্টিশক্তি নেই তার। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমাদেরকে তো চোখ দান করেছেন, দৃষ্টি শক্তি দিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন— 


  • "আমি কি তার জন্য সৃষ্টি করিনি চক্ষুযুগল? (যা দ্বারা সে দ্রর্শন করে থাকে)।”  [সুরা আল-বালাদ, আয়াত:০৮]


কিন্তু আমরা কি এ চোখের যথাযথ ব্যবহার করছি? আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ অনুযায়ী এর ব্যবহার করছি?


—না, আমারা প্রতিনিয়তই দৃষ্টির খিয়ানত করছি, আল্লাহ ত'আলা কর্তৃক নিষিদ্ধ বস্তুতে দৃষ্টি দিচ্ছি। এ দু'চোখ দিয়ে আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি হারাম দৃশ্য। গুনাহ দ্বারা বোঝাই করছি আমাদের আমলনামা। বেগানা নারীর দিকে ইচ্ছেকৃতভাবে তাকিয়ে থাকছি আমরা। মাল্টিমিডিয়ার এই ধূসর পর্দায় প্রতিনিয়তই হারাম দৃশ্য দেখছি, কলুষিত করছি আমাদের রূহ-কে। সুযোগ পেলেই হারিয়ে যাচ্ছি নীল রঙা এক জগতে। রাস্তায় সুন্দরী নারীর উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই এ দু’চোখকে লাগিয়ে দিচ্ছি নিজের কুপ্রবৃত্তির খোরাক বা চাহিদা পূরণ করার কাজে। এ ব্যাপারে কি আমরা আদৌ উদাসীন নই? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন— 


  • "মু’মিনদের বল তাদের দৃষ্টি অবনমিত করতে আর তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করতে, এটাই তাদের জন্য বেশি পবিত্র, তারা যা কিছু করে সে সম্পর্কে আল্লাহ খুব ভালভাবেই অবগত।"  [সুরা অন-নিসা, আয়াত:৩০]


আমরা অহরই জিনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন ইত্যাদি ঘটনা দেখছি। এসব অপরাধের সূত্রপাত কিন্তু দৃষ্টির  অবৈধ ব্যবহার থেকেই হয়; চাই তা বাস্তবে সরাসরি দৃষ্টিপাত হোক বা কোনো চিত্র কিংবা পর্দায় দৃষ্টিপাত হোক। আর এ দৃষ্টিই তো শয়তানের বিষাক্ত তীর। বড় বড় বিপর্যয়ের সূচনা এখান থেকেই হয়। যেমন বিশাল অগ্নিকাণ্ডের সূচনা ঘটে সামান্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গ থেকে। নিশ্চয় অপরাধের ক্রমপর্যায় হলো, প্রথমে দৃষ্টিপাত, তারপর কল্পনা, তারপর পদক্ষেপ, তারপর অপরাধ। আর যে নিজের দৃষ্টিকে অবনত রাখেনা, সে শয়তানের প্ররোচনায় সহজেই পতিত হয়। 


তাই আমাদের উচিৎ নিজের দৃষ্টির হিফাজত করা। চোখ দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার অনুমোদিত জিনিস দেখা, হারাম থেকে দূরে থাকা, দৃষ্টিকে সংযত রাখা। জীবনের  প্রতিটা পদক্ষেপেই আমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ হৃদয়ে অটুট রাখতে হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলার কাছে সাহায্য চাইতে হবে অর্জন করতে হবে তাকওয়া। 


আর বেশি বেশি ইস্তিগফার করতে হবে, ক্ষমা চাইতে হবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার কাছে। এ দু’চোখের অদৃশ্য নদী থেকে জলকে অশ্রুতে রূপান্তর করতে হবে, ঝরাতে হবে উষ্ণ অশ্রু। এতেই রয়েছে কল্যাণ। 



“ক্ষমা চাও ঐ রবের কাছে

সেজদায় যাও লুটিয়ে, 

তিনি তোমার সাথেই আছে

দুঃখ কষ্ট দেবে মিটিয়ে।


অশ্লীলতার কাছেও যেওনা 

হারাম হতে থাকো দূরে, 

কুরআন হলো সত্যের বাণী

শান্তি খোঁজো সত্যের সুরে।”



'উপলব্ধি' সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বে যেতে ক্লিক করুন

'উপলব্ধি' সিরিজের পরবর্তী পর্বে যেতে ক্লিক করুন

মন্তব্যসমূহ

  1. আমার ছেলে ক্লাস ৬ এ পড়ে। আপনার উপলব্দি সিরিজের প্রথম লেখাটা দিয়েছিলাম তাকে পড়ার জন্য। তার নাকি খুবই ভালো লেগেছে। সে আপনার লেখার ভক্ত বলা চলে, তাই অনুরোধ উপলব্ধি সিরিজটা চালিয়ে নিয়ে যান। আল্লাহ আপনার লেখায় বরকত দান করুক।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আল্লাহ তা'আলা লৌকিকতা থেকে হিফাজত করুক। ইন শা আল্লাহ, চেষ্টা চালিয়ে যাব।
      আপনার ছেলের জন্য আমার স্নেহ ও ভালোবাসা রইল।

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Popular Posts

"তাওহীদ– আমার বেঁচে থাকার কারণ"

"রাতের আকাশ ও রবের মহিমা: এক গভীর উপলব্ধি"

"Rat Race" —বিপর্যস্ত আত্মার খোঁজে