"স্বচ্ছ কাচের ঘর: গুনাহের সময় আমরা কি ভুলে যাই?"



'গ্রীনহাউজ'— নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। আমি যখন ৫ম শ্রেনিতে পড়ি তখন, প্রথম পরিচয় হয়েছিলাম নতুন এক ঘরের সাথে। যে ঘরের নাম 'গ্রীনহাউজ'।

শীতপ্রধান দেশে বিশেষ ধরনের কাচের তৈরি ঘরে কৃত্রিম পরিবেশে শাক-সবজি ও বিভিন্ন ফল-মূলের চাষাবাদ করা হয়ে থাকে। আর এই কাচের তৈরি ঘরগুলোই 'গ্রীনহাউজ' নামে পরিচিত।

সহজ ভাবে বলতে গেলে– গ্রীনহাউজ হলো 'একটি কাচের তৈরি ঘর'।

আর এ স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি ঘরের ভেতরে কি হচ্ছে, কোন গাছটির পানি প্রয়োজন, কোন গাছের সার বা কীটনাশক প্রয়োজন, কোন গাছটি কি অবস্থায় আছে সবই আমরা ঘরের বাইরে বসে দেখতে পারি। মোটকথা, ঘরের বাইরে বসে সবকিছু তত্ত্বাবধানে এই কাঁচের ঘর কোনো প্রকারের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না।


মনে করুন, আপনার বাড়ির উঠোনে একটি 'গ্রীনহাউজ' আছে। দুপুরে আপনি ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় আপনার বাড়িতে একজন চোর আসলো। সে আপনার ফোন, মানিব্যাগ, ল্যাপটপ ইত্যাদি মূল্যবান জিনিস নিয়ে পালানোর সময় আপনার ঘুম ভাঙে গেল। চোরটি দৌড়ে পালিয়ে সেই কাঁচের তৈরি গ্রীন হাউজ এর ভেতর লুকালো। আপনিও তাকে খুঁজতে বের হয়ে গেলেন। আচ্ছা বলুনতো, চোরটিকে খুঁজে বের করতে আপনার কি তেমন কোন কষ্ট হবে?

–না। অতি সহজেই আপনি চোরটিকে চিহ্নিত করতে পারবেন। কারণ, এ গ্রীনহাউজ তো স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি। চোরটি যত চেষ্টাই করুক না কেন গ্রীন হাউজের ভেতরে সে আপনার দৃষ্টির আড়াল হতে পারবে না।


আচ্ছা, এমন জায়গায় লুকোনোর ফলে কোন বিবেকবান, বুদ্ধিমান ও সুস্থ ব্যক্তি কি চোরটিকে 'চালাক' বলে সম্মোধন করবে? নাকি সকলে তাকে আস্ত গর্ধব বা বোকা বলে সম্মোধন করবে?

অবশ্যই সকলে তাকে 'আস্ত গর্ধব’ বা 'বোকা' বলবে। আর বলবে না-ই বা কেন, 'আস্ত গর্ধব' না হলে কি কেউ স্বচ্ছ কাচের তৈরি ঘরের ভেতর গিয়ে লুকোয়?


ঠিক আমরাও তার মতো ‘আস্ত গর্ধব’। এখন প্রশ্ন করতে পারেন, “আমরা আবার কিভাবে আস্ত গর্ধব হলাম?"

আমরা গুনাহ বা কোনো খারাপ কাজ করার আগে এমন একটি নির্জন স্থানের সন্ধান করি, যেখানে আমাদের কেউ দেখবে না।অথবা আমরা কাজটি এমনভাবে করার চেষ্টা করি, যাতে কেউ দেখতে না পায়। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে মোবাইল, কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপের সামনে বসে পড়ি, কলুষিত করি নিজের রূহ-কে, হাড়িয়ে যাই নীল রঙা এক জগতে। আমরা ভাবি– 'আরে! আমি তো এখন ঘরে একাই আছি, কেউ তো দেখছে না আমায়। এই বদ্ধ ঘরের ভেতর কেইবা আমায় দেখবে?'

আচ্ছা আসলেই কি আপনাকে কেউ দেখছেনা?

–অবশ্যই দেখছেন। আর তিনি হলেন আমাদের রব্ব— আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা। আমাদের রব্বের কাছে এ পৃথিবী, আমাদের অন্ধকার ও বদ্ধ ঘর বা কোনো গোপন স্থান— এসবই আসলে স্বচ্ছ কাচের তৈরি গ্রীন হাউজের মতো। আমরা যতই গোপনীয়তা অবলম্বন করিনা কেনো, আমার রব্ব ঠিকই আমাদের দেখছেন। ঠিক যেমন, আমরা বাইরে থেকেও গ্রীন হাউজের ভেতরের সবকিছু দেখতে পাই।


কাচের ঘরের বাইরে অবস্থান করা লোকটির কাছে যেমন ঘরের ভেতরের কোনো জিনিস গোপন থাকেনা, তেমনই আমিও আমার রব্বের কাছে কিছু গোপন করতে পারবো না। আল্লাহ তায়ালা কুরআনের বলেন—

“তোমরা যা গোপন রাখ এবং যা প্রকাশ করো, আল্লাহ তায়ালা তা জানেন।“ [সুরা নাহল, আয়াত:১৯]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা মানুষের সব অবস্থা ও কাজকর্ম সম্পর্কে অবহিত। পৃথিবীর অণু পরিমান বা তার চেয়ে ক্ষুদ্রতম জিনিসও তাঁর পর্যবেক্ষণের বাইরে না। দুনিয়ার কোনো শক্তি তাঁকে বাধা দিতে পারেনা, কারণ তিনি তো সর্বশক্তিমান, সর্বদ্রষ্টা। আল-কুরআনে অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তার এ সকল গুণের কথা উল্লেখ করেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন—

“নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন” [সুরা আন-নিসা, আয়াত:৫৮]


গুনাহ করার সময় আমরা মনে করি, কেউ দেখছেনা আমায় এ বদ্ধ ঘরের ভেতর। কিন্তু আমরা ভুলে বসি এক চিরন্তন সত্যকে। আর তা হলো–

"আমার রব্ব আমাকে দেখছেন।"


ঐ চোরটিকে আমরা ‘আস্ত গর্ধব’ বলছি কারণ, সে চুরি করে ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য আশ্রয় নিয়েছিলো 'স্বচ্ছ কাচের ঘরে'। সে ভেবেছিলো এর ভেতর হয়তো তাকে কেউ দেখবে না। একারণেই সে ঐ ঘরে লুকিয়েছিলো।

সে চোরটির মতো আমরাও তো ভাবি যে, বদ্ধ ঘরের ভেতর কেউ আমায় দেখবে না। তবে কি আমরাও সে চোরটির মতো 'আস্ত গর্ধব’ নই?

হ্যাঁ, আমরাই হলো প্রকৃত বোকা। দুনিয়ার এই ইট-পাথরের দালানের ভেতরে ঢুকেই আমরা মনে করি কেউ আমায় দেখছে না, ঘরের ভেতর আমি কি করছি তা কেউ টেরও পাবে না। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে আমার রব্বের কাছে এসব ইট-পাথরের দালান আসলে কিছুই না। আল্লাহ তা'আলা বলেন— 

“....তোমরা যেখানেই থাক তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন, তোমরা যে কাজই কর না কেন, আল্লাহ তা দেখেন।”  [সুরা হুদ, আয়াত:০৪]

তবুও আমরা কেনো গুনাহ্-এ লিপ্ত হই বারেবার?


“আমি ভুলে যাই কেনো বারেবার?

দেখছে আমায় রব;

তবু কেনো আমি করিনা ভয়,

হইনা কেনো সরব?”



তাই নিজের নফসকে পরিশুদ্ধ করুন। আপনি মনে করুন আপনি একটি 'সি.সি. ক্যামেরা'র আওতায় আছেন। যা ২৪ ঘন্টা আপনার উপর নজরদারি করছে। আর এ 'সি.সি. ক্যামেরা'টি হলো আল্লাহ রব্বুল আ'লামীনের দৃষ্টি, যার আওতায় আছেন আপনি। 'সি.সি ক্যামেরা'র আওতায় একটি চোর যেমন চুরি করা থেকে বিরত থাকে। তেমন আপনিও বিরত থাকুন গুনাহ করা থেকে। গুনাহ হয়ে গেলে সাথে সাথে তাওবা করুন, ইস্তেগফার করুন। আর ফিরে আসুন রব্বের পানে।



“হে প্রশান্ত আত্মা! ফিরে এসো তুমি,

তোমার রবের প্রতি।

শামিল হও তুমি নেক বান্দাদের সাথে

আর প্রবেশ করো রবের জান্নাতে।”

—[সুরা ফজর, আয়াত: ২৭-৩০]



 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Popular Posts

"তাওহীদ– আমার বেঁচে থাকার কারণ"

"রাতের আকাশ ও রবের মহিমা: এক গভীর উপলব্ধি"

"Rat Race" —বিপর্যস্ত আত্মার খোঁজে